এইচএসসি 2021 সালের পরীক্ষা অংশগ্রহণ করে মানবিক বিভাগের সপ্তম সপ্তাহের নির্ধারিত ইতিহাস প্রথম পত্র অ্যাসাইনমেন্টের উত্তর প্রকাশ করা হলো। আমরা আমাদের ওয়েবসাইটের বিশেষজ্ঞ শিক্ষকমন্ডলী দাঁড়ায় এইচএসসি 2021 সপ্তম সপ্তাহের ইতিহাস প্রথম পত্র এসাইনমেন্টের নির্ভুল এবং পূর্ণাঙ্গ উত্তর তৈরি করেছে যা শিক্ষার্থীদের পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নম্বর পেতে সহযোগিতা প্রদান করবে। পূর্ণাঙ্গ উত্তর পেতে প্রকাশিত আর্টিকেলের নিচের অংশ ভালভাবে দেখুন।
এইচএসসি 2021 (৭ম-সপ্তাহ) ইতিহাস প্রথম পত্র এসাইনমেন্ট উত্তর
প্রিয় এইচএসসি 2021 সালের পরীক্ষা অংশগ্রহণ করে মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থীরা। প্রকাশিত আর্টিকেল এর নিচে সপ্তম সপ্তাহের ইতিহাস প্রথম পত্র অ্যাসাইনমেন্ট এর প্রশ্নের ছবি এবং তার নিচে উত্তর সংযোগ করা হলো। যাতে করে শিক্ষার্থীরা প্রশ্নের ছবি দেখে নং অনুযায়ী উত্তর ডাউনলোড করে নিতে পারেন।
অ্যাসাইনমেন্টঃ
ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট ও প্রকৃতি এবং বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব।
উত্তরঃ
ক. ভাষা আন্দোলনের পটভূমিঃ
বাংলা ভাষা আন্দোলন ছিল তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত একটি সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন। ২ সেপ্টেম্বর ১৯৪৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় শিক্ষক ও ছাত্রের উদ্যোগে ‘তমুদুন মজলিস’ গঠনের মাধ্যমে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার ব্যাপক আন্দোলন শুরু হয় । তমুদুন মজলিসের নেতৃত্বে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন তরুণ অধ্যাপক আবুল কাশেম। মৌলিক অধিকার রক্ষাকল্পে বাংলা ভাষাকে তৎকালীন পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গণদাবীর বহিঃপ্রকাশ ঘটে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে এ আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ ধারণ করলেও বস্তুত এর বীজ বপিত হয়েছিল বহু আগে, অন্যদিকে এর প্রতিক্রিয়া এবং ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী।
১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ব্রিটিশ ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তানের উদ্ভব হয়। কিন্তু পাকিস্তানের দু’টি অংশ- পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে সাংস্কৃতিক, ভৌগােলিক ও ভাষাগত দিক থেকে অনেক মৌলিক পার্থক্য বিরাজ করছিল। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান সরকার ঘােষণা করে যে, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। এ ঘােষণার প্রেক্ষাপটে পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানকারী বাংলাভাষী সাধারণ জনগণের মধ্যে গভীর ক্ষোভের জন্ম হয় ও বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। পূর্ব পাকিস্তান অংশের বাংলাভাষী মানুষ আকস্মিক ও অন্যায্য এ সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে পারেনি এবং মানসিকভাবে মােটেও প্রস্তুত ছিল না।
খ. ভাষা আন্দোলনে ভাষা শহীদদের অবদানঃ
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের শহীদ সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউর, এঁদের একযােগে ‘ভাষা শহীদ’ হিসাবে মনােনীত করেছিলেন অসংখ্য শ্রোতা। বাহান্ন সালের একুশে ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে নিহত ভাষা শহীদদের অবদান কতটুকু সেটা হয়ত আজ পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশের নাম দেখলেই বােঝা যায়। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান অধিরাজ্য সরকার ঘােষণা করে যে, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। এ ঘােষণার প্রেক্ষাপটে পূর্ব বাংলায় অবস্থানকারী বাংলাভাষী। সাধারণ জনগণের মধ্যে গভীর ক্ষোভের জন্ম হয় ও বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। কার্যত পূর্ব বাংলার বাংলাভাষী মানুষ আকস্মিক ও অন্যায্য এ সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে পারেনি এবং মানসিকভাবে মােটেও প্রস্তুত ছিল না। ফলস্বরূপ বাংলাভাষার সম-মর্যাদার দাবিতে পূর্ব বাংলায় আন্দোলন দ্রুত দানা বেঁধে ওঠে।
আন্দোলন দমনে পুলিশ ১৪৪ ধারা জারি করে ঢাকা শহরে মিছিল, সমাবেশ ইত্যাদি বেআইনি ও নিষিদ্ধ ঘােষণা করে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি (৮ ফাল্গুন ১৩৫৮) এ আদেশ অমান্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু সংখ্যক ছাত্র ও প্রগতিশীল কিছু রাজনৈতিক কর্মী মিলে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন। মিছিলটি ঢাকা মেডিকেল কলেজের কাছাকাছি এলে পুলিশ ১৪৪ ধারা অবমাননার অজুহাতে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। গুলিতে নিহত হন বাদামতলী কমার্শিয়াল প্রেসের মালিকের ছেলে রফিক,সালাম, এম. এ. ক্লাসের ছাত্র বরকত ও আব্দুল জব্বারসহ আরও অনেকে।
এছাড়া ১৭ জন ছাত্র-যুবক আহত হয়। শহীদদের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়ে ওঠে। শােকাবহ এ ঘটনার অভিঘাতে সমগ্র পূর্ব বাংলায় তীব্র ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। ২১ ফেব্রুয়ারির ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে সারাদেশে বিদ্রোহের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। ২২ ও ২৩ ফেব্রুয়ারি ছাত্র, শ্রমিক, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক ও সাধারণ জনতা পূর্ণ হরতাল পালন করে এবং সভা বিদ্রোহের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। ২২ ও ২৩ ফেব্রুয়ারি ছাত্র, শ্রমিক, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক ও সাধারণ জনতা পূর্ণ হরতাল পালন করে এবং সভাশােভাযাত্রাসহকারে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে। ২২ ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে শহীদ হন শফিউর রহমান শফিক, রিক্সাচালক আউয়াল এবং অলিউল্লাহ নামক এক কিশাের।
ফেব্রুয়ারি ফুলবাড়িয়ায় ছাত্র-জনতার মিছিলেও পুলিশ অত্যাচার-নিপীড়ন চালায়। এ নির্লজ্জ, পাশবিক, পুলিশি হামলার প্রতিবাদে মুসলিম লীগ সংসদীয় দল থেকে সেদিনই পদত্যাগ করেন। ভাষা আন্দোলনের শহীদ স্মৃতিকে অম্লান করে রাখার জন্য মেডিকেল কলেজ হােস্টেল প্রাঙ্গণে রাতারাতি ছাত্রদের দ্বারা গড়ে ওঠে শহীদ মিনার, যা ২৪ ফেব্রুয়ারি উদ্বোধন করেন শহীদ শফিউর রহমানের পিতা। ২৬ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে শহীদ মিনারের উদ্বোধন করেন দৈনিক আজাদ পত্রিকার সম্পাদক জনাব আবুল কালাম শামসুদ্দীন। ক্রমবর্ধমান গণআন্দোলনের মুখে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার শেষ পর্যন্ত নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয় এবং ১৯৫৪ সালের ৭ই মে পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলা অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গৃহীত হয়।
১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান প্রণীত হলে ২১৪ নং অনুচ্ছেদে বাংলা ও উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উল্লিখিত হয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা প্রবর্তিত হয়। সর্বস্তরে বাংলার ব্যবহার নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সরকার ১৯৮৭ সালে বাংলা ভাষা প্রচলন আইন জারি করে।১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কো বাংলা ভাষা আন্দোলন, মানুষের ভাষা এবং কৃষ্টির অধিকারের প্রতি সম্মান জানিয়ে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘােষণা করে যা বৈশ্বিক পর্যায়ে সাংবার্ষিকভাবে গভীর শ্রদ্ধা ও যথাযােগ্য মর্যাদার সাথে উদ্যাপন করা হয়।
গ. বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্বঃ
তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানে (আজকের বাংলাদেশ) পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে সর্ব প্রথম যে আন্দোলনটি সংঘঠিত হয় তার নাম ভাষা আন্দোলন। পরবর্তীতে স্বাধীনতার আন্দোলনসহ অধিকার আদায়ের লক্ষে যত আন্দোলন সংঘঠিত হয়েছে তার সূতিকাগার ছিল এই মাতৃভাষা আন্দোলন! ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালির মনে এক সংগ্রামী চেতনা ও ঐক্যের সৃষ্টি হয় যা পরবর্তী সব আন্দোলনের অনুপ্রেরণা ও প্রাণশক্তি জোগায়। ভাষা আন্দোলনের অনুপ্রেরণা ও প্রাণশক্তিতে বলীয়ান হয়ে ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দলন, ১৯৬৯ সালের ৫ জানুয়ারি ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তিসহ ১১ দফা দাবি সংবলিত এক | সংবলিত এক কর্মসূচি ঘােষণা করে ঘােষণা করে ইতিহাসে যা ছাত্রদের ১১ দফা আন্দলন নাম খ্যাত! ইতােপূর্বে, ১৯৬৬ সালের ৭ মে রাষ্ট্রদ্রোহীতার অভিযােগে ও দেশরক্ষা আইনে আকটকৃত শেখ মুজিবুর রহমানকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ১৯৬৮ সালের ১৭ জানুয়ারি বেকসুর খালাস দেয়ার পর ১৮ জানুয়ারি জেল গেট থেকে সশস্ত্রবাহিনী কর্তৃক গ্রেফতার করে কুর্মিটোলা সেনানিবাসে নিয়ে যাওয়া হয়।
একই দিনে ৩ জন বেসামরিক কর্মকর্তাসহ সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর ২৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়। এর প্রতিবাদে আইয়ুববিরােধী আন্দোলন পূর্ববাংলার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। তৎকালীন ডাকসুর সহসভাপতি তােফায়েল আহমেদের নেতৃত্বে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। পরবর্তী পর্যায়ে এ আন্দোলন ব্যাপক আকার ধারণ করলে তা ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে রূপান্তরিত হয়। ইয়াহিয়া খান ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর জাতীয় পরিষদ এবং ১৭ ডিসেম্বর প্রাদেশিক পরিষদগুলাের সাধারণ নির্বাচন ঘােষণা করেন। ওই নির্বাচনে উভয় পরিষদে আওয়ামী লীগ বিপুল ভােটে জয়যুক্ত হয়। অর্থাৎ গণপরিষদ নির্বাচনে পূর্বপাকিস্তানে আওয়ামী লীগ প্রদত্ত ভােটের ৭৫.১১% এবং ১৬২টি আসনের মধ্যে ১৬০টি লাভ করে প্রাদেশিক পরিষদে ৭০% ভােট এবং ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৮৮টি লাভ করে। কিন্তু তাতেও পশ্চিম পাকিস্তানিরা ক্ষমতা না দেয়ায় বাঙালিরা বেছে নেয় মুক্তির শেষ চেষ্টা। আর এই কানেই ১৯৭১ সালের দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর অবশেষে ১৬ই ভাষা বলা যায়। আন্দোলনের গুরুত্ব ছিল মূখ্য।
ঘ. বাংলা ভাষার আন্তর্জাতিকায়নঃ
১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর বাংলা ভাষাকে সত্যিকার অর্থে বিশ্বায়নের পূর্ণরূপ দেয়ার জন্য জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তাঁর এই উদ্যোগের প্রথম বাস্তবায়ন হয় জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে। জাতিসংঘে কার্যক্রম পরিচালিত হয়। পাঁচটি ভাষায়। সব দেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী তথা জাতিসংঙ্গের নিযুক্ত প্রতিনিধিরা উক্ত পাঁচটি ভাষার যেকোনাে একটি ভাষায় ভাষুণ দেন। একমাত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালের ২৩ মার্চ জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে সদস্যরাষ্ট্র হিসেবে বাংলায় ভাষণদান করার ফলে বিশ্ববাসী জানতে পারে বাংলা ভাষার মহত্ব। ১৯৯৯ সালের নভেম্বর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে টঘঊঝঈঙ কর্তৃক বাংলা ভাষাকে স্বীকৃতি বিশ্বদরবারে এনে দিয়েছে এক বিশাল খ্যাতি।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে বিশ্বজুড়ে অমর একুশের উদযাপন নিঃসন্দেহে এক বিশাল জাতীয় গৌরব ও সম্মানের। ২০০০ সাল থেকে UNESCO এর সদস্য রাষ্ট্রগুলাে এ দিবসটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করে। ২০০১ সালের ১৫ মার্চ বিশ্বের সব মাতৃভাষার গবেষণা, উন্নয়ন ও সংরক্ষণে কাজ করার উদ্যোগে জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুনের উপস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন ঢাকার সেগুনবাগিচায়। বর্তমানে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট করেন ঢাকার সেগুনবাগিচায়। বর্তমানে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট ভাষাসংক্রান্ত গবেষণা,ভাষা সংরক্ষণ ও প্রশিক্ষণের পাশাপাশি এটি ভাষার ক্ষেত্র আন্তর্জাতিক সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করছে যা বাংলাভাষাকে বিশ্বমর্যাদায় আসীন করতে ভূমিকা রাখছে।
২০১০ সালের ৩ নভেম্বর। জাতিসংঘের ৬৫তম সাধারণ অধিবেশনে ৪র্থ কমিটিতে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের প্রস্তাবটি উত্থাপন করে এবং প্রস্তাবটি সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। ফলে এটি বাঙালি জাতি, বাংলা ভাষার প্রতি বিশ্ববাসীর অকুণ্ঠ সমর্থন এবং সম্মান প্রদর্শনের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করে। বাংলাদেশের সীমানা ছাড়িয়ে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিক চর্চা বিশ্বজুড়ে বেড়ে চলেছে। মাতৃভাষার সংখ্যার বিচারে বাংলা ভাষা পৃথিবীর একটি শক্তিশালী ভাষা। রাষ্ট্রীয় পর্যায় বাংলা ভাষা ব্যবহারকারী দেশের সংখ্যা মূলত একটি-বাংলাদেশ। ১ সাংবিধানিকভাবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। এর বাইরে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা প্রদেশ, আসাম প্রদেশের বরাক উপত্যকার অন্যতম প্রশাসনিক ভাষা বাংলা, ফলে ভারত ফলে ভারতের ক্ষেত্রে বাংলা একটি প্রদেশিক ভাষা।
ভারত উপমহাদেশের বাইরে একমাত্র আফ্রিকার সিয়েরালিওনে বাংলা ভাষাকে সরকারি ভাষার মর্যাদা দেয়া হয়েছে। সম্প্রতি ২০১৬ সালে অস্ট্রেলিয়ার সংসদ বাংলাকে স্বীকৃতির বিলু পাস করে। ফলে বাংলা ভাষা লাভ করে এক অনন্য মর্যাদা। এই মুহূর্তে বহির্বিশ্বে ৩০টি দেশের ১০০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু রয়েছে বাংলা বিভাগ, সেখানে প্রতি বছর হাজার হাজার অবাঙালি পড়ুয়া বাংলাভাষা শিক্ষা ও গবেষণার কাজ করছে। এছাড়া চীনা ভাষায় রবীন্দ্র রচনাবলির ৩৩ খণ্ডের অনুবাদ এবং লালনের গান ও দর্শন ইংরেজি ও জাপানি ভাষায় অনুবাদ হয়েছে। বাংলা ভাষা, সাহিত্য, ইতিহাস ও সংস্কৃতি নিয়ে বহির্বিশ্বে ভারত ও বাংলাদেশের পর ব্রিটেন ও আমেরিকায় সবচেয়ে বেশি চর্চা হয়ে থাকে। এর বাইরে চীন, জাপান, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, জার্মানি, পােল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশে বাংলা ভাষার সংস্কৃতি চর্চা হচ্ছে। আমেরিকায় কমপক্ষে ১০টি বিশ্ববিদ্যালয় ও এশীয় গবেষণা কেন্দ্রে বাংলা ভাষার চর্চা হচ্ছে। এর মধ্যে নিউইয়কশিকাগাে,ফ্লোরিডা, ক্যালিফোর্নিয়া, ভার্জিনিয়া উল্লেখযােগ্য। বিশ্বের ছয়টি দেশের রাষ্ট্রীয় বেতারে বাংলা ভাষার আলাদা চ্যানেল রয়েছে। আরও ১০টি দেশের রেডিওতে বাংলা ভাষার আলাদা অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা হচ্ছে।
ব্রিটেনে ছয়টি ও আমেরিকায় ১০টি বাংলাদেশি মালিকানাধীন ও বাংলা ভাষার টেলিভিশন চ্যানেল রয়েছে। বিট্রেনে ১২টি বাংলা সাপ্তাহিক পত্রিকা বের হয়। বেতার বাংলা নামে সেখানে একটি বাংলা রেডিও স্টেশন রয়েছে। ইউরােপের ইতালিতে বর্তমানে পাঁচটি বাংলা দৈনিক পত্রিকা এবং রােম ও ভেনিশ শহর থেকে তিনটি রেডিও স্টেশন পরিচালিত হচ্ছে। ইতালি থেকে ছয়টি অনলাইন টেলিভিশন এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগে শতাধিক ফেসবুক টেলিভিশন চালু রয়েছে। এছাড়া ডেনমার্ক সুইডেনসহ ইউরােপের আটটি দেশ এবং মধ্যপ্রাচ্যের ছয়টি দেশ থেকে বাংলা ভাষার মূদ্রিত ও অনলাইন পত্রিকা প্রকাশিত হয়। একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপিত হয় সারা পৃথিবীতে একুশে আমাদের মননের বাতিঘর হিসেবে। একুশ এখন সারা বিশ্বের ভাষা ও অধিকারজনিত সংগ্রাম ও মর্যাদার প্রতীক। সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের অহংকার শহীদ মিনার।
ঙ. ভাষা আন্দোলনে বাংলার নারীর ভূমিকাঃ
ভাষা আন্দোলনে বাংলার নারীরাও অগ্রবর্তী ভূমিকা রেখেছিলেন, স্কুল-কলেজবিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীসহ গৃহিণীরাও পর্যন্ত সে সময় প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ভাষা সৈনিকেরা পরবর্তীতে অকপটে স্বীকার করেছেন ছাত্রজনতার পাশাপাশি এই ভাষাকন্যাদের বীরত্বমন্ডিত গাঁথা, তাঁদের স্বতঃস্ফুর্ত বলিষ্ঠ অবদান। বায়ান্ন’র ২১ শে ফেব্রুয়ারীতে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে প্রথম রাজপথে নেমে আসেন যারা-তা ছিল দশজন করে মেয়েদের তিনটি দল। এঁদের তৃতীয় দলটি সর্বপ্রথম পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন। পরে অবশ্য তাঁদেরকে ছেড়ে দেয়া হয়। পরবর্তীতে এই বীর কন্যাদেরকে নিয়ে গবেষণাধর্মী কাজ হয়েছে খুব কম; বদরুদ্দীন ওমরের ‘ভাষা আন্দোলন প্রসঙ্গঃ কতিপয় দলিল’, আহমেদ রফিকের ‘একুশের ইতিহাস আমাদের ইতিহাস’, তুষার আবদুল্লাহ সম্পাদিত নারীগ্রন্থ প্রবর্তনা থেকে প্রকাশিত ‘বায়ান্নর ভাষাকন্যা বইলাে সেই স্বল্পসংখ্যক বইগুলাের ভেতর উল্লেখযােগ্য।
বায়ান্নর ভাষাকন্যা’ বইটিতে ১৭ জন ভাষা কন্যাকে তুলে ধরা হয়েছে ভাষা আন্দোলনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে; তাঁরা হলেন রওশন আরা বাচ্চু, সুফিয়া খান, সারা তৈফুর, ডঃ শরিফা খাতুন, হালিমা খাতুন, প্রতিভা মুৎসুদ্দি, কায়সার সিদ্দিকী, মােসলেমা খাতুন, সুফিয়া আহমেদ, গুলে ফেরদৌস, মনােয়ারা ইসলাম, রওশন জাহান হােসেন, কাজী খালেদা খাতুন, রওশন আহমেদ দোলন, হােসনে আরা বেগম, জুলেখা হক ও নাদেরা বেগম প্রমুখ।
নাদেরা বেগম ভাষা আন্দোলনে ছাত্রীদের পক্ষে নেতৃত্ব দেয়ার কারণে কারারুদ্ধ হয়ে কঠিন নির্যাতন ভােগ করেছিলেন। নারায়ণগঞ্জ মডার্ণ গার্লস স্কুলের প্রধান শিক্ষিকাকেও একই কারণে গ্রেফতার করা হয়– এই ঘটনায় নারায়ণগঞ্জের জনগণ বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিল এবং তাকে যাতে ঢাকায় নিয়ে না যেতে পারে সেজন্য কয়েক মাইলব্যাপী রাস্তায় শত শত গাছ কেটে ব্যারিকেড সৃষ্টি করেছিল। নাদেরার স্বামী তাঁকে মুক্ত করার চেষ্টা করেন, কিন্তু বন্ড সই করে মুক্তিলাভে নাদেরা অস্বীকৃতি জানালে তার স্বামী তাঁকে ডিভাের্স দেন। স্কুলে কালাে পতাকা উত্তোলনের অপরাধে সিলেটে সালেহা বেগমকে সেখানকার ডিসির নির্দেশে তিন বছরের জন্য স্কুল থেকে বহিস্কার করা হয়েছিল।